শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক এতিমের গল্প:-
---------------------------------------------------------



বাংলাদেশের এক অজোপাড়া গ্রামে জন্ম বিপ্লবের।বাবা আরমান মিয়া দিনমজুর, আর মা আমেনা বেগম গৃহিণী।কোন রকম দিন চলে যায় তাদের। বাবা মায়ের একমাত্র আদরের সন্তান বিপ্লব।

ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায় খুবই মনযোগী সে।পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্ট পুলে বৃত্তি পেয়ে সবার দৃষ্টি কাড়ে সে,যথারীতি অষ্টম শ্রেণীতেও পায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি।বিপ্লবকে নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগে গ্রামের এক হাইস্কুলে ভর্তি করান তার বাবা।

বাবা মায়ের স্বপ্ন সে অনেক বড় হবে।এস.এস.সি তে বিপ্লব গোল্ডেন এ+ পেয়ে সবাইকে অবাক করে দেয়। তার স্কুল থেকে সেই একমাত্র ছাত্র যে গোল্ডোন এ+ পায়।এরপর উপজেলার এক কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয় হয় বিপ্লব।এইস.এস.সি তে আবার  গোল্ডেন এ+ পেয়ে নিজের মেধার স্বাক্ষর রাখে ।

বিপ্লব এবার স্বপ্ন দেখে দেশের স্বনামধন্য কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার।কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে যায় তার জীবনের সবথেকে মর্মান্তিক আর হৃদয় বিদারক ঘটনা।আরমান মিয়া হার্ট এ্যাটাকে মারা যান।পরিবারের হাল ধরার মত আর কেউ নাই।এদিকে খুব ভেঙে পড়ে সে, পড়াশুনাতে তার আর মন বসে না।কিছুদিন চলে যায় এভাবে। বিপ্লবের মা  ছেলেকে তার বাবার স্বপ্ন পূরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেন,ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন তার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধে কম্পিটিশন করার প্রস্তুতি নিতে এবার তাকে ভর্তি হতে হবে কোন কোচিং সেন্টারে,কিন্তু কোচিং এ ভর্তি হবার মত টাকা বিপ্লবের জোটে না।এদিকে  দুবেলা খাবার যোগাড় করতে আমেনা বেগম কাজ নেন পাশের গ্রামের এক ইট ভাটায়।বিপ্লব বুঝে উঠতে পারে না কি করবে, পড়াশুনা নাকি মায়ের কাজ বন্ধ করে  নিজেই  নেমে পড়বে কাজে।

কোন রকম পড়াশুনা করে আর এসব চিন্তায় বিভোর হয়ে নির্ঘুম রাত কাটে তার। ঘনিয়ে আসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময়।বিপ্লব সব চিন্তা বাদ দিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যায় পুরোদমে, ভর্তি হবার সুযোগ পায় রাজধানী  ঢাকার ভিতরে এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগে।

কোন রকম ধারদেনা করে আমেনা বেগম ছেলের ভর্তির টাকা যোগাড় করে দেন।বিপ্লবের ভাগ্য এতটাই মন্দ যে, সে যে ভার্সিটিতে চান্স পায় সেখানে কোন হল নেই।থাকবে কোথায়...খাবে কি... এসব চিন্তায় মাথা ঘুরতে থাকে তার।নিষ্ঠুর এ শহরে যে কেউ কারও না।

অনেক কষ্টে ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে থেকে  একটা টিউশিনি পায়,সম্মানী ৪,০০০ টাকা। কিন্তু এ টাকা দিয়ে তার মেসের সিট ভাড়া আর অনুসঙ্গিক খরচ দিতেই শেষ হবে,খাবে কি? এদিকে মায়ের অসুক,মায়ের কাজ করার ক্ষমতাও নেই আগের মত।কোন রকম মেসের মিল অফ করে,প্রতিদিন ৩ কিলো হেঁটে টিউশিনি করে নিজের খরচ মেটাতে থাকে বিপ্লব ।মায়ের জন্য তার মনের অবস্থা খুবই খারাপ।মাকে একপলক দেখার জন্য মন ছটপট করে সবসময়।কথা বলার জন্য মায়ের কাছে মোবাইলও নেই, প্রতিবেশী এক বড় ভাইয়ের মোবাইলে ফোন দিয়ে মাঝেমধ্যে মায়ের খোঁজ নেয় বিপ্লব।খুব শখ মাকে একটা ফোন কিনে দিবে সে।

মাস কয়েক পরে টিউশিনির পাশাপাশি একটা পার্টটাইম কাজ করার সুযোগ পায় বিপ্লব।ইদানিং পড়াশুনার সময় মেলাতে খুব কষ্ট হয় তার।টিউশিনি আর পার্টটাইম কাজের পর গভীর রাতে বাসায় ফেরে সে।ক্যাম্পাস টাইমে বন্ধুরা যখন আড্ডা দেয়,খোশগল্পে মেতে থাকে সে সময়টুকুই বিপ্লবের পড়ার সময়।এদিকে মায়ের অসুখ বেড়েই চলেছে। মায়ের সাথে কথা বল্লেই সব ছেড়ে বাড়ি যেতে মন চায় তার।এ জগৎ সংসারে মা ছাড়া যে আর কেউ নাই।

আজ বিপ্লব টিউশিনি আর পার্টটাইম এর বেতন পেয়েছে,মায়ের জন্য একটা ফোন কিনেই সে মেসে ফিরে। মাকে একটা ফোন দিবে বলে এতদিন স্বপ্ন দেখত,আর আজ তার হাতে মায়ের জন্য নতুন ফোন।বাসায় ফেরার পরেই আজ  তাই বিপ্লব বেজায় খুঁশি, এতটাই খুঁশি যে পরদিন থেকে তার সেমিস্টার ফাইনাল সেটা ভুলে গিয়েছে।হঠাৎ মনে পড়ে পরীক্ষার কথা।  সারাদিনের ক্লান্তি শেষে আজ তার পড়তে বসতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।কোনরকম প্রধান প্রধান টপিক্সগুলো চোখ বুলায় সে।পরীক্ষার ভিতরে টিউশিনি আর পার্টটাইম চাকরি করতে তার খুব কষ্ট হয়।কিন্তু মায়ের জন্য একটা ফোন কিনতে পেরেই যেন সে, সব কষ্ট এক নিমিষেই ভুলে যায়।পরীক্ষার ভিতরে সে দিন গুনতে থাকে কবে আসবে শেষ পরীক্ষাটি।অবশেষে সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আসে সেই দিনটি।

বিপ্লব টিউশিনি আর পার্টটাইম জব থেকে একসপ্তাহ ছুটি নিয়েছে।এ এক সপ্তাহ মায়ের সাথে কাটাবে বলে  কত পরিকল্পনা তার ।পরীক্ষা শেষ করে বিপ্লব তখন তার ব্যাগ গোচাচ্ছে।  দীর্ঘ ছয় মাস মায়ের সাথে দেখা হয় নি,মায়ের মুখখানা দেখার জন্য মনটা ছটফট করতে থাকে ।আনমনে সে ভাবতে থাকে মায়ের অসুখ তাকে দেখলেই ভাল হয়ে যাবে।
এগুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার মোবাইল বেজে উঠে, মোবাইল হাতে নিতেই চোখে পড়ে বাড়ির পাশের সেই বড়  ভাইয়ের নাম্বার, ফোন রিসিভ করতেই কান্নার শব্দ ভেসে উঠে বিপ্লবের কানে।ওপাশ থেকে কাঁদতে কাঁদতে বলতে শোনা যায় বিপ্লব তোর মা আর নেই......

এস.এম.নাসির উদ্দীন,
শিক্ষার্থী, ফার্মেসী বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন